এস,এম,হাবিবুল হাসান : সাতক্ষীরায় মহামারি করোনার লকডাউনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় জেলায় বাল্য বিয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১০৯ জাতীয় হটলাইনে কথা বলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন প্রতিকার মেলে না। দুর্নীতিবাজ বিবাহ রেজিস্ট্রার ও ইউপি সদস্যদের কেউ কেউ এই বে-আইনী কাজে সহযোগিতা করছেন। আর এই কাজে নিত্য নতুন অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়ারও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার ৭৮টি ইউনিয়নে ৭৮জন এবং দুটি পৌরসভায় ৯জন করে ১৮জন বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার আছেন। এছাড়া সনাতন ধর্মের বিবাহ পড়ানোর জন্য রয়েছেন পুরোহিত। জেলার বাল্যবিবাহে এসব রেজিস্ট্রার ও পুরোহিতরা না করলে অভিভাবকরা চলে যায় নোটারী পাবলিক কার্যালয়ে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে টাকার লোভে পড়েও বিবাহ কার্য সম্পাদন করার খবর আসে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এ কাজে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে গত ছয় মাসে তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। তবে এসব বিবাহের অধিকাংশই দেওয়া হয়নি রেজিস্ট্রি কাগজপত্র। স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল করিম ও বিবাহ রেজিস্ট্রার মো. সিরাজুল ইসলাম টাকার বিনিময়ে এ বাল্যবিবাহ দেন। প্রশাসনিকভাবে এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সচেতনতার অভাবে এ অঞ্চলে বেড়েই চলেছে বাল্যবিবাহ।
জেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি প্রশাসনিক প্রধান সাকিবুর রহমান বাবলা জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত নগরঘাটা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। এর অধিকাংশই দিয়েছেন ওই এলাকার বিবাহ রেজিস্ট্রার মো. সিরাজুল ইসলাম। তবে, বাল্যবিবাহ পড়ালেও দেওয়া হয়নি রেজিস্ট্রি কাপজপত্র।
তিনি আরও জানান, নগরঘাটার ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল করিম এসব পরিবারে কাছে থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীকে সঠিক তথ্য না দিয়ে এসব বিবাহ দিতে সহযোগীতা করেন।
তিনি আরও বলেন, ১০৯ জাতীয় হটলাইন নাম্বারটি অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকে। দু-একটি অভিযোগ গ্রহণ করলেও তার সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এমন কি হটলাইনে যোগাযোগ করা হলে তারা অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগই করে না। আবার অনেক সময় উপজেলা প্রশাসন সরাসরি বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে যেতে না পারলে স্থানীয় চেয়ারম্যান অথবা মেম্বারদের উপর দায়িত্ব দেন। তারাও ভোটের কারণে সকলের সাথে সমন্বয় করে উপজেলা প্রশাসনকে ভুল বুঝিয়ে বিবাহ দিয়ে থাকে।
নগরঘাটা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে বাল্যবিবাহের বিষয়ে জেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি প্রশাসনিক প্রধান মো. সাকিবুর রহমান বাবলা সর্বশেষ ৩ আগস্ট মঙ্গলবার তালা উপজেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে জেলা বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি সভাপতিসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছেন।
এ ওয়ার্ডে যাদের বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে-নগরঘাটা ইউনিয়নের পোড়ার বাজার এলাকার বাবলু দর্জি মেয়ে কবি নজরুল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণি ছাত্রী লতিফা (১৩), একই এলাকার নাজমুল (১৭)। বাগপাড়ার সফি কারিকরের মেয়ে বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্রী টুম্পা, একই এলাকার মৃত মোস্ত মিস্ত্রীর ছেলে মোটর ভ্যান চালক মাকসুদ (১৭), বাগপাড়ার রবিউল কারিকরের মেয়ে নগরঘাটা গার্লস স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণি ছাত্রী মুক্তা (১৩), বাজার শ্রমিক ছাব্বির (১৮), বাগপাড়া রবিউল কারিকরের মেয়ে নগরঘাটা গার্লস স্কুলের ৭ম শ্রেণি ছাত্রী হিরা (১৫), বাগপাড়ার রুহুল আমিন দর্জি মেয়ে নগরঘাটা গার্লস স্কুলের ৭ম শ্রেণি ছাত্রী লিজা (১৪), পোড়ার বাজারের আকতারুলের মেয়ে নগরঘাটা গার্লস স্কুলের ৭ম শ্রেণি ছাত্রী জেসমিন (১৪), কুলপাড়া-টাওয়ার মোড়ের তেজেনের মেয়ে তামান্না (১৫), বাগপাড়া আরিফুলের মেয়ে নগরঘাটা গার্লস স্কুলের ৭ম শ্রেণি ছাত্রী খাদিজা (১৪), পোড়ার বাজারের কামরুলের মেয়ে নগরঘাটা গার্লস স্কুলের ৯ম শ্রেণি ছাত্রী সাদিয়া পারভীন পুষ্প। বাগপাড়া (মুখের বাড়ি) বিপ্লব (১৮), মিঠাবাড়ি সাদিয়া (১৪), পোড়ার বাজারের আমানত মোড়লের মেয়ে মারুফার বাল্য বিবাহ হয়েছে। এর মধ্যে মারুফার পরিবারকে মোবাইল কোর্ট পাঁচ হাজার টাকা জরিমান করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) তালা এবং পুষ্পার পরিবারকে তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেন।
খোজ নিয়ে জানা যায়, বাল্যবিবাহ রোধে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। এসব মিলিয়ে জেলায় এ কমিটিতে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি সদস্য রয়েছে। তবে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সরাসরি দায়িত্ব পালন করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ছাড়া তেমন কাউকে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না।
তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল করিম বলেন, কার মেয়ের কোন বয়সে বিবাহ হলো, তা যেনে আমি কি করবো। আমার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই।
নগরঘাটা ইউনিয়নের বিবাহ রেজিস্ট্রার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি কাগজপত্র ঠিক দেখে বিবাহ পড়াই। তবে অনেক সময় সব কিছু ঠিকভাবে দেখা হয় না। সে ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমি না পড়ালেও অনেকে বাইরে থেকে বিবাহ কার্য শেষ করেন।
তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, আমরা সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিবাহ বন্ধ করছি। কিন্তু পরে অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে বিবাহ করছে। তিনি আরও বলেন, যে সব বাল্যবিবাহ সংগঠিত হয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে মামলা করতে হবে। কিন্তু প্রতিদিন নতুন নতুন বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হিমশিম খাচ্ছি। তাই লুকিয়ে বিবাহ করা বাল্যবিবাহের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, যে সব বাল্য বিবাহ হচ্ছে তার কোন কাগজ পত্র দেওয়া হচ্ছে না। মৌাখিকভাবে বিবাহ পড়ানো হচ্ছে।
তালা উপজেলা বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি সভাপতি ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তারিফ-উল-হাসান বলেন, ইতোমধ্যে বাল্য বিবাহ দেওয়ার জন্য সেখানে জরিমানা করা হয়েছে। মুচলেকাও নেওয়া হয়েছে কয়েকটি। তবে, অনেক সময় অভিযোগের কোন প্রমানপত্র অর্থাৎ রেজিস্ট্রি কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভবও হচ্ছে না। তারপরও যদি কেউ বাল্যবিবাহ করে থাকে সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সহকারী কমিশানার (ভূমি), উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা সার্বক্ষণিক চেষ্টা করে যাচ্ছে।