জিয়াউদ্দিন লিটনঃ
মাহাতো বাংলাদেশ, নেপাল, মরিশাস ও ভারতে বসবাসকারী অন্যতম প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত মাহাতোদেরও রয়েছে নিজেস্ব ভাষা ও পরিচিতি,সামাজিক রীতি-নীতি, আচার ও কৃষ্টিকালচার, বর্ণ পরিচয় এবং সামাজিক বৈচিত্রতা যা তাদেরকে একটি নিজেস্ব জাতিসত্ত্বা হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে সহযোগীতা করেছে। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস হলো ভারতের কুচবিহার জেলা বর্তমান ঝাড়খন্ড প্রদেশের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলাতে এদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়, তবে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও সলংগা থানায় এবং বগুড়া জেলার শেরপুর থানায় এরা বেশির ভাগ বসবাস করে। তাছাড়াও জয়পুরহাট জেলার কাশপুর, মহিপুর, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থানায়, নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানায়, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী, তানোর ও নাচোলে, পাবনা জেলার চাটমোহরে, ফরিদপুর জেলার বালিয়াকান্দি ও বোয়ালমারী থানায়, নাটোর ও খুলনা জেলার কয়রা ছাড়াও সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায়ও বেশ কিছু মাহাতো পরিবারের বসবাস লক্ষ্য করা যায়।
মাহাতোরা এই উপমহাদেশীয় আর্য এবং দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মিশ্রণের ফলে সৃষ্টি। এদের দৈহিক গঠন বাঙালীদের মতই। এদের গায়ের রং সাধারনত উজ্জ্বল শ্যামলা, তবে বেশির ভাগ ফর্সা। এদের দৈহিক গঠন মাঝারি, বেটে ও লম্বা ধরনের।মাহাতোদের আদি নিবাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস হলো ভারতের বর্তমান ঝাড়খন্ড প্রদেশের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখান থেকে কতদিন আগে তাঁরা বাংলাদেশে আসে তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি।
মাহাতোরা খুবই কর্মঠ, নিরীহ ও শান্ত স্বভাবের মানুষ। ঝগড়া, গন্ডগোল, অশান্তমিুলক কার্যকলাপকে তাঁরা প্রশ্রয় কিংবা তাতে কখনই অংশগ্রহণ করে না। তারা সব সময় নিজেদের মধ্যে এবং অপরদের মধ্যে সর্বদা মিলে মিশে থাকতে বেশি পছন্দ করে।তাদের প্রধান আর্দশ হচ্ছে যে, “যদি প্রত্যেকের মধ্যে পারস্পারিক সহানুভূতি না থাকে তাহলে কিভাবে একটি শান্তিময় সমাজ তারা পাবে”।
তাদের এ নিরীহ ও সরল স্বভাবের জন্য তৎকালীন ভারতবর্ষের ঊগ্রপন্থি শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত ছিল। ধর্মান্তকরণ করার জন্য তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী তাদের উপর নানা কৌশলে অত্যাচার করত। ধারণা করা হয়, মাহাতোরা যেহেতু অত্যাচারিত ছিল তাই তারা এই ঊগ্রপন্থি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে।যেহেতু মাহাতোরা ছিল খুবই পরিশ্রমী এবং সৎ বাংলার জমিদাররা মাহাতোদের বাংলায় আসার আমন্ত্রণ জানায় ।
মাহাতোরা জাতি হিসেবে খুবই পরিশ্রমী এরা নিজের গায়ের ঘাম ঝরানো অর্থ ছাড়া অন্যের অর্থকে নিজের ব্যবহারের কথা কখনো চিন্তাও করে না। যেহেতু মাহাতোরাঅত্যাচারিত ছিল তাই তারা অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য জমিদারদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বাংলাদেশে আসে এবং বসবাস শুরু করে বলে বেশি মত পাওয়া যায়। কারও কারও মতে,মাহাতোরা কেবল যে, জমিদারদের আমন্ত্রনে বাংলায় এসেছিল তা পুরো পুরি ঠিক নয়। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজ পিতৃভূমি ছেড়ে এদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল এবং লুকিয়ে বনজঙ্গলে বসবাস শুরু করেছিল।
তাঁরা মনে করে মাহাতোরা মুলত ক্ষত্রিয় বংশধর, নিজেদের সুযোগ সুবিধা এবং নিজেদের রক্ষা করার মত সমস্ত জ্ঞান তাদের ভিতর ছিল, কারণ তারা ছিল ক্ষত্রিয় বংশধর শান্তিযুদ্ধ করা এবং প্রতিরোধ করা ছিল তাদের আর্দশ কিন্তু তারা সংখ্যাই ছিল সীমিত এবং সীমিত জনবলের কারণে তারা তৎকালীন ঊগ্রশাসক গোষ্ঠীর সাথে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে আসে এবং খুবই নিরীহ জীবন যাপন করে, তবে এরা যে খুবই কর্মঠ ছিল তা শতভাগ সত্য। এরা এত সহজ সরল এবংতীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী যে, যেকোন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে এবং কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। মাহাতোদের জীবন প্রণালী খুবই সহনশীল ধরনের। এই মানুষ গুলো হলো বর্তমান বাংলাদেশে বসবাসকারী মাহাতো জাতিগোষ্ঠী।
মাহাতোরা অর্থাৎ বেশির ভাগ মাহাতো যারা বাংলাদেশে আছে তারা কুর্মী গোত্রের । কুর্মী কিংবা এদের অন্যান্য গোত্র আছে কিন্তু এরা নামের শেষে মাহাতো কথাটি ব্যবহার করে বলে এরা মাহাতো নামে অধিক পরিচিত। আসলে এরা সবাই কুর্মীগোত্রের অর্ন্তগত কারণ এদের ভাষা কুর্মালী যা ভারতের ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিম বঙ্গ, আসামে এখনো প্রচলিত আছে এবং মাহাতোরা নিজেদের মধ্যে কুর্মালী ভাষায় কথা বলে। আর এদের পবিত্র গ্রন্থ “অ্যাইনাস”, মানুষ মারা গেলে তাঁর আত্মার মুক্তির জন্য পাঠ করা হয় এবং কোন কাজ শুরু করার আগে এই “অ্যাইনাস” গ্রন্থ পাঠ করা হয়, যা দেব নাগরী বা কুর্মালী ভাষায় রচিত।
কেউ কেউ ধারণা করেন কুর্মী মাহাতোদের কিছু অংশ প্রথমে ঢাকার কুর্মীটোলায় হয়তো বসবাস শুরু করেছিল তাই হয়তো স্থানীয় লোকজন এই জায়গার নাম দিয়েছেন কুর্মীদের নাম অনুসারে কুর্মীটোলা। তাছাড়া হিন্দুদের পবিত্র ও প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ এর একটি শাখা ঋদবেগেও কুর্মী সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। মুলত গোত্রগত দিক থেকে এরা সবাই কুর্মী হলেও এদের সম্প্রদায়ের নাম মাহাতো। এরা সবাই এদের নামের শেষে মাহাতো কথাটি ব্যবহার করে।
মাহাতোদের মধ্যে অনেক গুলো গোত্র আছে। প্রায় ৮১ টার মতো গোত্র আছে। টিডুয়ার, কাটরিয়ার, শাখুয়ার, কানবিঁধা, ডুমরিয়ার, পুনরিয়ার, নাগটুয়ার, লাঠুয়ার ইত্যাদি।তারা নিজের গোত্রের মধ্যে বিয়ে করে না, নিজের গোত্রের লোকদের নিজের বংশের লোক বলে মনে করে এবং নিজের গোত্রের মধ্যে বিয়ে কে পাপ কাজ বলে ধরে নেয়। তবেসুর্যাহির সময়, জিতিয়ার সময়, জন্ম- মৃত্যুর সময় একই গোত্রের সব লোক এক নিয়মে সামাজিক আচারাদি করে থাকে। মাহাতো পুরুষরা ধুতির সাথে শার্ট পরতে বেশিপছন্দ করে,তবে এখন তারা লুঙ্গিও পরে। মেয়েরা সাধারণত শাড়ি পরে তবে তাদের শাড়ি পেচিয়ে পরার ধরন আলাদা ধরনের, এটাকে মাহাতোরা “চিচিং চিংগঘা” বলে থাকে।
অলংকার হিসেবে পুরুষরা কানে সোনার এক ধরনের গোলাকৃতির কানাসি পড়ে আর মেয়েরা হাতে পড়ে কাটাবাজু, পায়ে গড়মল, গলায় ধানবিছা, কোমরে ফিতা ও তারাহারা বা তারার মত অলংকার পড়ে। আগের দিনে সব মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের সুদৃশ্য স্থায়ী ট্যাঁটু আকঁতো শরীরের বিভিন্ন অংগে। মাহাতোদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত, রুটি, মাছ। তাছাড়া তারা পাঠার মাংস, খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস, হাঁস, মুরগীও খায়। মাহাতোদের প্রধান কাজ হলো কৃষিকাজ। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই একসাথে মাঠে কাজ করে থাকে।এছাড়াও শ্রমিক হিসাবেও অন্যের জমিতে মজুর খাটে। এটা সত্য যে মাহাতোরাই প্রথম এদেশের ভূমি বাসযোগ্য করেছে, বন জঙ্গল পরিস্কার করে আবাদি করেছে। অথচ তাঁরাই এখন ভূমিহীন। মাহাতোরা আগে সবাই নিরক্ষর ছিলো। কিন্তু এখন অনেক ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করছে। তাদের ছেলেমেয়েরা বেশ মেধাবী কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক কারনে পড়াশুনার সুযোগ কম পায়। তাদের মাতৃভাষায় (কুর্মালি) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় বাংলা ভাষায় শিখতে প্রথমদিকে বেশ বেগ পেতে হয় মাহাতো ছেলেমেয়েদের।
মাহাতোদের সমাজ ব্যবস্থা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত এক “গ্রাম ভিত্তিক” ও “সমাজ ভিত্তিক”। গ্রাম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় একজনকে “গ্রাম্যপ্রধান” নির্বাচন করা হয়। গ্রামে যিনি সবচেয়ে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষনশীল তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি হন এবং তার পর খেকে তিনি “মাহাতোয়া” নামে সমাজে পরিচিত লাভ করেন। গ্রামের যেকোন ধরনের সমস্যা ও সমাধানে সর্বদা তার সহযোগিতা নেওয়া হয়। গ্রাম ভিত্তিক যে কোন পুজায় কর্মী তেরী করা এবং দায়িত্ব বণ্টন করা, বিবাহ, মৃত ব্যক্তির সৎকার ও শ্রাদ্ধ কিংবা গ্রাম ভিত্তিক যে কোন কাজ তার প্রত্যক্ষ পরিচালনায় সম্পাদিত হয়। সর্বোপরি বলা যায় “মাহাতোয়া” গ্রামের হর্তাকর্তা কিন্তু তিনি যদি কোন অন্যায় করেন তাহলে গ্রামের মুরুব্বীগণ তাঁকে সতর্ক করেন, এরপরও সংশোধন না হলে সবাই মিলে তার “মাহাতোয়া” পদটি কেড়ে নেন, তাই তিনি স্বেচ্ছাচারিতা হতে পারেন না। আর সমাজ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় যে কয়টি গ্রাম নিয়ে সমাজ গঠিত হয়, সে কয়টি গ্রামের মাহাতোয়াদের মধ্যে একজনকে সমাজের প্রধান নির্বাচন করা হয়ে থাকে যাকে “সমাজপতি” বলা হয়। সমাজের যেকোন কাজে গ্রাম্যপ্রধান বা মাহাতোয়ারা “সমাজপতিকে” সহযোগিতা করেন। কোন কারণে কোন গ্রামে যদি ঝগড়া কিংবা কোন আপত্তিকর ঘটনা ঘটে তাহলে তারা গ্রামের মাহাতোয়া অর্থাৎ গ্রাম্যপ্রধানের কাছে বিচার চান, গ্রাম্য প্রধান যদি কোন কারণে সিদ্ধান্ত দিতে না পারে তবে সমাজের সকল গ্রাম্যপ্রধান এবং যিনি সমাজপতি হন তিনি সহ সবাই মিলে বিষয়টি মিমাংসা করেন।
মাহাতো সমাজে পিতৃপ্রধান প্রথা চালু আছে, তবে নারীদেরও সমাজে বিশেষ সম্মান আছে। মাহাতোদের ভাষার নাম মুলত “কুর্মালী ভাষা”। কুর্মী জাতির নাম অনুসারে এদের ভাষার নাম কুর্মালী ভাষা। কুর্মীদের কথা যেহেতু বেদে উল্লেখ আছে, তাই মাহাতোরা যে, আদিম যুগ হতে আছে তা সতত প্রতিয়মান। মাহাতোরা নিজেদের মধ্যে এই মাহাতো কুর্মালী ভাষায় কথা বলে। কুর্মালী ভাষার ধরন হলো আধা সংস্কৃতি ও আধা হিন্দি মেশানো। এই কুর্মালী ভাষাটা ইন্দো- এ্যারিয়ান ভাষা শ্রেণী ভূক্ত। কুর্মালী ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। মাহাতোরা নিজ ভাষায় কথা বলতে খুবই গর্ববোধ করে তাছাড়াও তারা বাংলা এবং স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারে। জন্মের পর এরা সাধারণত শিশুদের মাতৃভাষা হিসেবে কুর্মালী ভাষা শেখায় কারণ তারা পরিবারে সবাই এই ভাষায় কথা বলে।
মাহাতো সম্প্রদায় সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী কেননা তারা মনে করে, তাদের কুর্মীর কথা প্রাচীন গ্রন্থ বেদে উল্লেখ আছে তাই তারা মনুর সন্তান। আর এ জন্য মাহাতোরা বেদ,রামায়ণ, মহাভারত, গীতা প্রভুতি গ্রন্থের কথা বিশ্বাস করে এবং মেনে চলে। ধর্মের প্রতি এদের এত বিশ্বাস যে, ধর্মান্তরীত যুগে খৃষ্টান মিশনারি এবং মুসলিমদের জোর করে ধর্মান্তকরন এর অবস্থাতেও তারা একজনও ধর্মান্তরিত হয়নি। নানা প্রলোভন, নানা অত্যাচারের মধ্যেও তারা আজোও সনাতন ধর্মকে আকড়ে ধরে আছে। যেখানে অন্য সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গণহারে ধর্মান্তরীত হয়েছে সেখানে তারা আজও অবিকৃত রয়েছে। তারা এত ধর্মভীরু যে, যখন তাদের এলাকায় অর্থাৎ সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, তাড়াশে এবং বগুড়ার শেরপুরে ওয়ার্ল্ডভিশন নামে একটি দাতা সংস্থা আসে এবং গুজব ছড়ায় যে, এই সংস্থাগুলো খৃষ্টান কর্তৃক পরিচালিত তাই তারা সংস্থাগুলোকে সম্পুর্ণরুপে বর্জন করে, এমনকি এদের পরিচালিত প্রাথমিক স্কুল গুলোতে ছেলে মেয়েদের পর্যন্ত আসতে দিত না। হয়তো এরা এদের পূর্ব পুরুষকে বেশি শ্রদ্ধা করে বলেই এরা আজোও সনাতন ধর্ম এবং সনাতনের আদর্শ সহিষ্ণুতা বুকে নিয়ে বেঁচে আছে।
মাহাতোরা মুলত সনাতন ধর্মের অনুসারী বলে এরা বিভিন্ন দেব দেবীর প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং পূজা করে। তারা অন্যান্য হিন্দু ধর্মের অনুসারী জাতিগোষ্ঠীর মত দুর্গা, লক্ষী, সরস্বতী, শিব প্রভুতি মুর্তি পূজা করে। আবার এদের নিজেস্ব কিছু পূজা যেমন সূর্যপূজা অর্থাৎ মাহাতোরা একে “সূর্যাহি” পূজা বলে। পরিবারে পুত্র সন্তান জন্ম নিলে পুত্রের বয়স যখন এক বছর হয় তখন “সূর্যাহি”পূজা করে সন্তানের মাথা মুন্ডন করানো হয়, আবার মাহাতোদের অনেক গোত্রের মধ্যে বিবাহের সময়ও “সূর্যাহি” করার প্রচলন আছে।
এসময় তারা দুই দিন উপবাস করে কেবল মাত্র গুড় দিয়ে রান্না করা ভাত খেয়ে। মাহাতোদের প্রধান উৎসব হলো “শহরায়”। কার্তিক মাসের আমাবস্যার রাত্রিতে তারা ঢোল,করতাল বাজিয়ে গ্রামের প্রতি বাড়ি বাড়ি গিয়ে “শহরায়” উৎসবের গান (রাহা মাতো হেরিন রে এ, রাহা মাতো হেরিন রে, রাহা রাহা রে এ) গায় আর চুয়ানি মদ খেয়ে রাত্রি “জাগারণ” করে। এই উৎসবে তারা সকল আত্নীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেয় এবং মজা করে। রাত্রি জাগরণের পরের দিন করে “গহালপূজা” অর্থাৎ যে ঘরে তারা গরু রাখে সেই গোয়ালঘরে পাঠা / পাঠি ছাগল জবাই করে বলে এর নাম “গহালপূজা”। মাহাতো অবিবাহিত মেয়েদের জন্য আছে আলাদা পূজা যাতে কেবল মেয়েরা অংশগ্রহণ করতে পারে। এই পূজাটির নাম হলো “কারামপূজা” বা “ডালপূজা”।
করম গাছের ডাল আঙ্গিনার মাঝখানে পুঁতে পাড়ার সকল মেয়েরা নতুন নতুন পোশাক পরে কাঁসার থালায় পূজার উপকরণ নিয়ে আসে এবং আঙ্গিনায় পোতা করম গাছের ডালের চারপাশে ঘিরে বসে। তবে এই পূজা করার আগে মেয়েরা নির্দিষ্ট তিথিতে বাঁশে তৈরী ছোট ছোট দুটি থালা আকৃতি ডালায় মাটি দিয়ে নানা রকম ডালের বীজ বোপন করে এবং ডালাগুলো খুব যত্ন করে রাখে। প্রতিদিন রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়ার পর পাড়ার সবমেয়েরা একত্রিত হয়ে ডালা দুটিকে বাড়ির আঙ্গিনায় রেখে দল বেধে ডালার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নানা রকম গীত গায় এভাবে চলে পাঁচদিন। পঞ্চম দিনে হয় পুজা। পুজা শেষ হলে মেয়েরা গীত গেয়ে ঢোলের তালে তালে ঝুমুর নাচে। আবার বিবাহিত মহিলাদের জন্য আছে “জিতিয়াপুজা” নামে ভিন্ন পুজা। জিতাষ্টমী তিথিতে এই পুজা করা হয় বলে এই পুজার নাম মাহাতোরা দিয়েছে “জিতিয়াপুজা”। এই পুজায় বিবাহিত মহিলারা উপবাস থেকে সাত পাড়া ঘুরে একে অপরের বাড়ি থেকে নানা রকম ডাল জাতীয় দ্রবাদি এবং শাক চেয়ে আনে।
চেয়ে আনা দ্রব্য গুলো দিয়ে তরকারী রান্না করে এবং আতব চাউল দিয়ে ভাত রান্না করে একে অপরের বাড়ি বিতরন করে। এই রান্না করা ভাত-তরকারীকে তারা পবিত্র মনে করে। এই পুজাটি ঠিক “কারামপুজার” মত হয় পার্থক্য হলো কারামপুজায় অবিবাহিত মেয়েরা অংশগ্রহণ করে আর জিতিয়া পুজায় বিবাহিত মহিলারা অংশগ্রহণ করে। আর একটি পার্থক্য হলো কারামপুজায় করমগাছের ডাল ব্যবহার করা হয় আর জিতিয়া পুজায় পাকৈড় গাছের ডাল ও আঁখেরগাছ (মাহাতোরা যাকে কুশাল বলে) ব্যবহার করা হয়।
মাহাতোরা নিজ সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না, তবে যদি কেউ এই নিয়মের ব্যতিক্রম করে তাহলে সমাজ থেকে তাকে একঘরে করে রাখে অর্থাৎ সমাজ তার সাথে সহযোগিতার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। মাহাতোরা বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের মুরব্বীদের মতামতের প্রাধান্য দেয়। মাহাতো সম্প্রদায় মনে করে যদি বিবাহের ক্ষেত্রে সন্তানদের মতামতের প্রাধান্য দেওয়া হয় তাহলে সমাজে অবক্ষয় শুরু হবে, যার পরিণতি খুবই খারাপ। বিয়ের পাঁচ কিংবা তিন দিন আগে লগ্ন বাধা যাকে মাহাতো ভাষায় “লাগান বান্ধা” বলা হয়, এর পর থেকে তারা নিমন্ত্রণ দিতে শুরু করে। নিমন্ত্রণের সাক্ষী হিসেবে তারা পান খাওয়ার “সুপারি” ব্যবহার করে।
সাধারণ আত্নীয়দের দুটি করে সুপারি দেয় এবং জামাই শ্রেণীর আত্নীয় স্বজনকে তারা তিনটি করে সুপারি দেয়। লগ্ন বান্ধার দিন থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত প্রত্যেক দিন রাত্রে পাড়ার সকল মেয়েরা বর ও কন্যার গায়ে হলুদ দিয়ে দেয়। এসময় তারা নানা রকম বিয়ের গীত গায় এবং আনন্দ করে। যেদিন বিয়ে, সেদিন তারা বরের বাড়ি থেকে দুপুর বেলা কন্যার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়, তবে যাওয়ার আগে মহিলারা বরকে সাথে নিয়ে “অমলো” খাওয়ার উদ্দেশ্যে আমগাছের নিচে নিয়ে যায়। আম গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে বরকে দেওয়া হয় কচি আমের পাতা চিবানোর জন্য।
কোন রকম চিবানো হলে পাতা চিবানো অবস্থায় মুখে পানি নেয়, বরের মুখের এই পানি মহিলারা বরকেকোলে নিয়ে তার মুখ থেকে অল্প অল্প করে মুখে দেয় এবং আর্শিবাদ করে, একে”অমলো খাওয়া” বলে। এরপর গরুর গাড়ি অথবা পাল্কিতে করে বিয়ে করার উদ্দেশে কনে বাড়ি যেত যদিও এখন বিভিন্ন যানবাহন ব্যাবহার করে। কনে বাড়ি পৌছার সাথে সাথে পাড়ার সকল কৌতুহলি মানুষ গুলো বরকে দেখতে বরের গাড়ির কাছে ভিড় জমায়। মহিলারা কাঁসার থালার মধ্যে আতপ চাউল, দুর্বাঘাস, দিয়ালী জ্বালিয়ে বরকে আহব্বান জানায়। এসময় বরপক্ষের সাথে কন্যা পক্ষের “নটুয়া” খেলা হয়।
এই খেলায় বাঁশের তৈরী করা ঢাল ও তলোওয়ার ব্যবহার করা হয়। যারা খেলায় জেতে তাদের “মেড়লা” উপহার দেওয়া হয়, মেড়লা হলো পিঠা ভর্তি বড় কলস। বিবাহ বাসর হিসেবে বাড়ির আঙিনায় বর্গাকৃতির একটি ঘের তৈরী করা হয় যা কে মাহাতোরা “মাড়োয়া” বলে। এই মাড়োয়ার উপরে কাপড়ের সামিয়ানা টানানো হয় এবং মাড়োয়ার মাঝ খানে চারটি ছোট কলা গাছ রোপন করে বিবাহ মন্ডব তৈরী করে, যার মাঝখানে চারটি কলস রাখার মত স্থান তৈরী করে। বিবাহ মন্ডবটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। চারটি ছোট কলস মন্ডবের মাঝ খানে রেখে মখে চারটি দিয়ালী রেখে বাতি জ্বালানো হয়। তারপর কন্যাকে মাড়োয়ার মাঝখানে পিঁড়িতে বসিয়ে কন্যার গায়ে সোনা পিতল পর্শ করানো হয় একে মাহাতো ভাষায় “সোনাপিতার” বলে। তারপর মহুয়া গাছের পাতা দিয়ে অমলো খায়।
এরপর কন্যাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে সাজানো হয়। কন্যাকে সাজিয়ে বাঁশের ডালিতে বসিয়ে শুন্যি করে মাড়োয়ার মাঝখানে বরের সামনে নিয়ে আসে এসময় কন্যা তার মুখ পানপাতা দিয়ে ঢেকে রাখে। বর মন্ডপের এক পাশে দাঁড়িয়ে আর যারা কন্যাকে ডালিতে ধরে নিয়ে আসে তারা মন্ডপের চারপাশে একবার ঘুরে বরের সামনা সামনি কনেকে নিয়ে আসে, তখন বর কন্যার পানপাতা সহ হাত সরিয়ে মুখ দর্শন করে তখন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, একে শুভ দৃষ্টি বলে। এভাবে শুভ দৃষ্টির সময় বর কন্যার মাথায় সাত পাকে সাত বার সিঁদুর দিয়ে দেয় শুভ দৃষ্টি সম্পন্ন করে। তারপর ব্রাহ্মন মন্ত্র পড়ে বিবাহ সমাপ্ত করে। তবে আগে কার দিনে ব্রাহ্মন এর প্রচলন ছিল না ।
তবে কোন কোন পরিবার বিয়ের পরের দিন সকালে আবার বাসি বিয়ে দেয়, বাসি বিয়ে এজন্য বলা হয় কারণ সকাল বেলা টিউবওয়েল বা পুকুর পাড়ে বিয়েটি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে কন্যা বরকে গোসল করিয়ে দেয়। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে ব্রাহ্মন বাসি বিবাহ সম্পন্ন করেন। মাহাতো বিয়েতে পণ প্রথা আছে। তবে সেটা ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষকে দেয়। আর পণ হিসাবে আগে কাপড় দেওয়ার চল থাকলেও পরে ২৫০-৭০০ টাকা দেওয়ার চল হয়। কাপড় দিতে হতো মেয়ের সব কাকি, মামি, নানি, দাদী ইত্যাদি সম্পর্কীয় লোকদের, যা অনেক গরীব পরিবার দিতে পারতো না।
হটাৎ করে কোন ব্যক্তি মারা গেলে সমাজের সবাইকে মৃতদেহ সৎকারের জন্য নিমন্ত্রন করে। সবাই একত্রিত হলে মৃত ব্যক্তিকে সনাতন ধর্মীয় মতে শ্মশানে নিয়ে সৎকার করা হয়। মৃতদেহ সৎকারের পর শ্মশান বন্ধুগণ সহ সবাই পুকুরে গোসল করে, যে যার ঘরে ফেরে “আগুন কেটে” অর্থাৎ মাটি বাটখোরার মধ্যে আগুন ও সরিষা রেখে বাটখারাটি শরীরের চার পাশে ঘুরিয়ে শরীরকে পবিত্র করে, তারপর সেই বাটখারাটি মাটিতে রেখে তার উপর দিয়ে পার হয় বলে একে “আগুনকাটা” বলে। মৃত্যুর দিন থেকে তৃতীয় দিনের দিন মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে করা হয় “তিনাকামান” অর্থাৎ তিন দিনের নির্ধারিত শ্রাদ্ধ্য। মৃত ব্যক্তিকে যারা শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল বা যারা সাথে শ্মশানে গিয়েছিল তারা সবাই সেদিন আবার পবিত্র হওয়ার উদ্দেশ্যে হাতের নখ, মাথার চুলকাটা, গোফ-দাড়ি পরিষ্কার করে।
দশদিনের দিন করা হয় দশাশ্রাদ্ধ্য, পুকুর ঘাটে পিন্ডদান, সমাজের সকল মানুষকে ভোজ খাওয়ানো ইত্যাদি কাজ দিনে সম্পন্ন করা হয়। বারদিনে হয় “বারোহা”। এইদিনে রাত্রিতে যে ঘরে লোকটি মারা যায় বা যে ঘরে সে রাত্রিতে ঘুমাতো, সেই ঘরে মৃত ব্যক্তির জন্য দেওয়া হয় “সামাজ” অর্থাৎ সামাজ এই জন্য বলা হয় যে, এই দিন রাত্রে সমাজের সকল মুরুব্বীদের ডেকে রাত্রিভর “অ্যাইনাস” পাঠ করে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে মঙ্গলাচারণ অনুষ্ঠান করা হয়। এরপরের দিন থেকে সেলাই বিহীন কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরিধান করে এবং সাভাবিক জীবন যাপন শুরু করে পিণ্ড দানকারীগণ।
মাহাতোরা একত্রে মিলেমিশে গোত্র ভিত্তিক জীবন যাপন করে আসছে। মাহাতো রা এতোই গোত্র ভিত্তিক যে তাদের একজনের কোন অনুষ্ঠান হলে সবাই আমন্ত্রন পায়,পুরা সমাজ একসাথে অনুষ্ঠান পালন করে থাকে, সেটা বিয়ে হোক বা মৃত্যুর অনুষ্ঠান হোক। তারা প্রথমে বিভিন্ন পরিত্যক্ত অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল, আর তাই যে সকল জমি তারা জঙ্গল সাফ করে তৈরী করে নিজেরা আবাদ করত সেগুলোর কোন দলিল ছিল না বলে স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলমানরা তাদের জমি জবর দখল করেছে। মাহাতোদের বেশির ভাগ ঘর বাড়ি মাটির তৈরী এবং পাশাপাশি। তবে সময়ের সাথে সাথে তাদের সেই ঘর এখন ইটের তৈরীও দেখা যায়। এরা যেখানে বসবাস করছে তা পূর্বে জঙ্গলে পরিপূর্ন ছিল।
বাড়ির চারপাশের জঙ্গলে বাঘের মত হিংস্র প্রাণী রাত্রিতে দাপিয়ে বেড়াতো। এদের অনেকে বন্য প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত ও আহত হতো। তাই তারা যে আদিম অধীবাসীদের মত জীবন ধারণ করেছে তার প্রমাণ মেলে এদের অতীত কথায়। তারা কথা বলত মাহাতো কুর্মালী ভাষায় বলে স্থানীয় মুসলমানরা তাদের সাথে মিশতে চাইতো না, “বুনা” বলে ডাকতো। একদিকে ভাষাগত অসুবিধা, অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর সাথে যুদ্ধ করে কিভাবে এরা সমাজে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে তা মনে করলে মন আৎকে উঠতে চায়। এদের বাড়ি মুলত মাটির দেওয়াল দিয়ে তৈরী, উপরে চালা হিসেবে শন, পাট, খড়পাতা দিয়ে তৈরী করা হয়। যারা গরীব তারা বাঁশের কুনচি দিয়ে তৈরী ঘরে বাস করে। ইদানিং ধনী মাহাতোরা চালা হিসেবে টিন ব্যাবহার করছে, মাঝে মাঝে ইটের তৈরী বাড়িও নজরে পড়ে।
মাহাতো বাড়িতে বেড়াতে গেলে। তাহলে তারা সমাদর করে বসার জন্য কাঠের তৈরী পিঁড়ি দিবে অথবা বাঁশ দড়ির তৈরী খাট নতুবা খেজুর পাতার তৈরী শীতলপাটিতে বসতে দিবে, আর পা ধোঁয়ার জন্য এক লটা পানি দিবে।
মাহাতো ভাষায় প্রথম উপন্যাস “কারাম”। মাহাতোদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন উজ্জ্বল মাহাতো। মাহাতো ভাষায় প্রথম নাটক “হটংটয়া”। নাটকটি রচনা ও পরিচালনা করেন দেবা মাহাতো ও রবীন্দ্রনাথ মাহাতো । কুর্মালি ভাষায় অনেক ঝুমুর, গান, বিবাহ গীত, বিভিন্ন উৎসবে অনেক গীত গেয়েছেন পরেশ মাহাতো। বাংলাদেশে একমাত্র পরেশ মাহাতোই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই সব গান করে থাকেন।
লেখকঃ জিয়াউদ্দিন লিটন
শিক্ষক সাংবাদিক ও কলামিস্ট।